জুলহাজ্জের প্রথম দশকঃ ফজিলত ও আমল
আরবি বার মাসের মধ্যে “জুলহাজ্জ” মাস অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং ফজিলতপূর্ন। এ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে মুসলিম মিল্লাতের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হজ্জ, ঈদুল আজহা, কুরবানি, আরাফার মাঠে উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। তাই এসব দিক থেকে এ মাসটি যেমন গুরুত্ববহ, তেমনি আমলের জন্য মাসটি অত্যন্ত ফজিলতে ভরপুর।
এ মাসের ফজিলতঃ
ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল যিলহজ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ [বুখারী : ৯৬৯; আবূ দাউদ : ২৪৪০; তিরমিযী : ৭৫৭]
আমল সমূহঃ
১. ঈদের দিন ছাড়া বাকি নয় দিন রোযা
রাখাঃ
আশারায়ে যিলহজ্জের আরকেটি বিশেষ আমল হলো— ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নয়টি দিবসে (যিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিন) রোযা রাখতেন। [সুনানু আবু দাউদ: ২৪৩৭, মুসনাদে আহমাদ: ২২২৩৪; সুনানু নাসা‘ঈ: ২৪১৬]
অন্য হাদীসে হযরত হাফসা রা. বর্ণনা করেন—
أربع لم يكن يدعهن النبي صلى الله عليه وسلم : صيام عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر وركعتين قبل الغداة.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্জের প্রথম দশকরে রোযা, প্রত্যকে মাসের তিনদিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। [সুনানে নাসা‘ঈ: ২৪১৫, সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৪২২, মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৭০৪২, মুসনাদে আহমাদ: ২৬৩৩৯]
২. বিশেষভাবে নয় তারিখের রোযা রাখাঃ
যিলহজ্জের নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখের রোযা সর্বাধিক ফযীলতর্পূণ। সহীহ হাদীসে এই দিবসের রোযার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي بعده والسنة التي قبله.
আরাফার দিনের (নয় তারিখের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন। [সহীহ মুসলিম: ১১৬২, সুনানু আবু দাউদ: ২৪২৫, জামে আ-তিরমিযী: ৭৪৯, সুনান ইবনে মাজাহ: ১৭৩০]
অপর এক হাদীসে এসেছে—
من صام يوم عرفة غفر له سنتين متتابعتين.
যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের (গুনাহ) ক্ষমা করা হবে। [মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৭৫৪৮, মাজমাউয যাওয়াইদ: ৫১৪১]
৩. চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটাঃ
যিলহজ্জের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ র্পযন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, অবাঞ্ছিত লোম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।
হযরত উম্মু সালামা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إذا رأيتم هلال ذي الحجة وأراد أحدكم أن يضحي فليمسك عن شعره وأظفاره.
তোমরা যদি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। [সহীহ মুসলমি: ১৯৭৭, জামে আত-তিরমিযী: ১৫২৩, সুনানু আবু দাউদ: ২৭৯১, সুনানু নাসায়ী: ৪৩৬২, সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস: ৫৮৯৭]
যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة. قال له رجل :يا رسول الله! أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك.
আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়ছে)। আল্লাহ তা‘আলা তা এ উম্মাতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়ছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুণ্ডন করবে অথবা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হব। [মুসনাদে আহমাদ: ৬৫৭৫, হাদীসটি সহীহ (আহমদ শাকের); সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭৭৩, সুনানু আবু দাউদ: ২৭৮৯, সুনানু নাসা‘ঈ: ৪৩৬৫]
৪. তাকবীর, তাহমীদ ও তাসবীহ পড়া : এসব দিনে তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। এ দিনগুলোয় যিকর-আযকারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’[বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৩৪৭৪; মুসনাদ আবী আওয়ানা : ৩০২৪]
তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপ : (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।) উল্লেখ্য, বর্তমানে তাকবীর হয়ে পড়েছে একটি পরিত্যাক্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সুন্নত। আমাদের সকলের কর্তব্য এ সুন্নতের পুনর্জীবনের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচারণা চালানো।
৫. হজ ও উমরা সম্পাদন করা : হজ ও উমরা এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ যাকে তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায় হজ বা উমরা করার তাওফীক দান করেন তার পুরস্কার শুধুই জান্নাত। কারণ, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘এক উমরা থেকে আরেক উমরা এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা এবং মাবরূর হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’[বুখারী : ১৭৭৩; মুসলিম : ৩৩৫৫]
আর মাবরূর হজ সেটি যা পরিপূর্ণভাবে সম্পাদিত হয় রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায়। যাতে কোনো রিয়া বা লোক দেখানো কিংবা সুনাম বা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর মানসিকতা নেই। নেই কোনো অশ্লীলতা বা পাপাচারের স্পর্শ। যাকে বেষ্টন করে থাকে নেক কাজ ও পুণ্যময় আমল।
৬. পশু কুরবানী করা : এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীকে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন।’ {সূরা আল-কাউসার, আয়াত : ০২}
এই দশদিনের অন্যতম সেরা প্রিয় আমল হলো কুরবানী। কুরবানীর পশু জবাই ও গরিবদের মধ্যে এর গোশত বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ হয়। এর দ্বারা গরিবদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায় এবং তাদের কল্যাণ সাধন হয়।
এ ছাড়াও বেশি বেশি নফল সালাত, দান সদকা এবং খালেস দেলে তওবা করার সুবর্ণ সুযোগ মুমিনরা হাত ছাড়া করে না।
তথ্যসূত্রঃ
- বাংলা হাদিস ডটকম
- পয়গম ডটকম
- কুরআনের আলো ডটকম
- বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিনের আমল-আলী হাসান তৈয়ব।
- সহিহ বোখারি
- মেশকাতুল মাসাবিহ
[লেখকঃ গোলাম রব্বাণী রোমান। চেয়ারম্যান, আন-নূর সাইন্টিফিক মাদরাসা, সোনাতলা, বগুড়া।]